
বি এম শফিকুল ইসলাম টিটু, সিনিয় চীফ রিপোর্টার (বাংলাদেশ) গত তিন বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার প্রায় ২৮ শতাংশ বেড়ে গেছে। সরকারি হিসাবে ২০২২ সালে এ হার ছিল ১২ দশমিক ৭ শতাংশ, যা চলতি বছরে এসে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে। গত বছরের চেয়ে এই অর্থ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে অনেকটাই। সরকারি হিসাবে ২০২২ সালে এ হার ছিল ১২ দশমিক ৭ শতাংশ, যা চলতি বছরে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিবারের মাসিক মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যায় খাবার কেনায়। খাবার কিনতে মাসে গড়ে ১০ হাজার ৬১৪ টাকা খরচ হয়। এছাড়া প্রতি মাসে শিক্ষায় ১ হাজার ৮২২ টাকা, চিকিৎসায় ১ হাজার ৫৫৬, যাতায়াতে ১ হাজার ৪৭৮ ও আবাসনে ১ হাজার ৮৯ টাকা খরচ হয়।
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডি ভবন মিলনায়তনে পিপিআরসি আয়োজিত ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউজহোল্ড লেভেল ইন মিড–২০২৫’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে সংস্থাটির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান গবেষণার বিভিন্ন দিক উপস্থাপন করেন। গত মে মাসে ৮ হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়।
পিপিআরসির গবেষণা অনুসারে অতি দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, সরকারি হিসাবে ২০২২ সালে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২৫ সালে এসে অতি দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে। এখনো ২৮ শতাংশ পরিবার যেকোনো সময় গরিব হয়ে যেতে পারে। সংস্থাটি বলেছে, বর্তমানে দেশের ওপর তিন ধরনের সংকটের প্রভাব চলমান রয়েছে। এগুলো হলো কভিড (২০২০-২২), মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।
পিপিআরসি আরো বলেছে, গত বছরের আগস্টের পর ঘুস কমলেও তা বন্ধ হয়নি। গত বছরের আগস্টের আগে গবেষণায় মতামত প্রদানকারীদের ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ সেবা নিতে ঘুস দিয়েছেন। আগস্টের পর এ হার ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমেছে। সবচেয়ে বেশি ঘুস দেয়া হয়েছে সরকারি অফিসে। এর পরে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের ঘুস দেয়ার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।
পিপিআরসির গবেষণায় আরো উঠে এসেছে, তিন বছরের ব্যবধানে শহরের পরিবারের মাসিক আয় কমেছে, কিন্তু খরচ বেড়েছে। শহরের একটি পরিবারের গড়ে মাসিক আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা হলেও খরচ হয় ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। ২০২২ সালে শহরের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা। তবে গ্রামের পরিবারের গড় আয় কিছুটা বেড়েছে। গ্রামের একটি পরিবারের গড় আয় ২৯ হাজার ২০৫ ও খরচ ২৭ হাজার ১৬২ টাকা। ২০২২ সালে গ্রামের পরিবারের গড় আয় ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা। জাতীয়ভাবে একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। খরচ হয় ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা।
পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘শুধু সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক দেখলেই হবে না। আমাদের মনোযোগ দিতে হবে মানুষের কল্যাণে, জীবনের বাস্তবতায় এবং সম্পদের ন্যায্য বণ্টনে। বাংলাদেশ এখন এক “কর্মসংস্থান জরুরি অবস্থা”র মুখোমুখি। কর্মরত হিসেবে গণনা করা লোকজনের মধ্যে ৩৮ শতাংশ আসলে আংশিক বেকার (সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার কম কাজ করছেন)। নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ ২৬ শতাংশে স্থবির। প্রায় অর্ধেক কর্মী স্বনিয়োজিত, যা যেমন টিকে থাকার কৌশল, তেমনি অনিশ্চয়তার প্রতীক। অর্থনৈতিক গণতন্ত্র শুরু হয় তখনই, যখন আমরা নীতিকে মানুষের চোখ দিয়ে দেখি।’
হোসেন জিল্লুর রহমান আরো বলেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় পাঁচটি নতুন ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। প্রথমত, আমাদের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী রোগের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। ক্রনিক রোগ মোকাবেলার জন্য একটি নতুন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, নারীপ্রধান পরিবারগুলো সমাজের সবচেয়ে নিচের স্তরে পড়ে আছে, তাই এদের বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, ঋণের বোঝা বাড়ছে, যা একটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠছে। চতুর্থত, ক্রমবর্ধমান খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। এটি এখনো ব্যাপক আকারে হয়নি, তবে ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং যা উদ্বেগজনক। পঞ্চমত, স্যানিটেশন সংকট উত্তরণ করে এসডিজি অর্জনের জন্য আমাদের হাতে মাত্র পাঁচ বছর আছে, কিন্তু এখনো প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ নন-স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহার করছে। ফলে নিরাপদ স্যানিটেশন নিশ্চিত করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
গবেষণায় বলা হয়, ১৫ শতাংশ পরিবার মাসে গড়ে প্রায় ২৯ হাজার টাকা প্রবাসী আয় পাচ্ছে, যদিও তা মূলত উচ্চ আয়ের পরিবারে কেন্দ্রীভূত। ৭৪ শতাংশ পরিবার, যেসব পরিবারে তরুণ-তরুণী আছে, তাদের ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। বাড়তি খরচ সামলাতে পরিবারগুলো বহুমুখী জ্বালানি ব্যবহার করছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিভাজন যেমন আছে, দৃঢ়তাও তেমনি প্রবল। সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোর ৬২ শতাংশ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হলেও সবচেয়ে দরিদ্র এক-তৃতীয়াংশ পরিবার সরাসরি নৈরাশ্য প্রকাশ করেছে। তবু সামগ্রিকভাবে অর্ধেকেরও বেশি (৫৪ শতাংশ) মানুষ সতর্ক আশাবাদী। পরিবারগুলো মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে ধনী-গরিব নির্বিশেষে তাদের আকাঙ্ক্ষা একই শিক্ষা, নিরাপদ কর্মসংস্থান, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ।