
নাহিদ হাসান: জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগামী নির্বাচনে একা, নাকি জোটগতভাবে অংশ নেবে; বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতায় যাবে, নাকি আলাদা জোট করবে- এ নিয়ে রাজনীতিতে নানা আলোচনা রয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর ২৭ সেপ্টেম্বরের প্রথম পাতার খবর।
দৈনিকটি জানাচ্ছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী- দুই দলের সঙ্গেই এনসিপির যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু পথচলার শুরুতেই দলটি কোনো বড় দল বা মতের ‘ট্যাগ’ গায়ে লাগাতে চায় না। তারা ‘মধ্যপন্থি’ দল হিসেবে নিজেদের পরিচিতি দাঁড় করিয়ে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে চায়। এমন চিন্তা থেকে সমমনা বা কাছাকাছি মনোভাবের বিভিন্ন দলকে নিয়ে পৃথক নির্বাচনী মোর্চা করার কথা ভাবছে তারা। এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ তিনজন নেতা বলেছেন, তারা তৃতীয় একটি জোট বা সমঝোতায় থাকতে চান। তবে নির্বাচনে কোথাও কোথাও বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে আসনভিত্তিক সমঝোতা হতে পারে।
এনসিপির তাত্ত্বিক নেতাদের সাবেক গুরু হাসনাত কাইয়ূম। তিনি প্রায় আট মাস আগে এই আকাক্সক্ষাটি ব্যক্ত করেছিলেন। পরে সেটি গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়া অসম্ভব নয়। কেন এই চিন্তার উদ্ভব?
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানের বেলায় এনসিপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলোর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে তারা জামায়াতের মতো সংগঠিত নয়। তাদের তাহলে সংসদে প্রতিনিধি আনার উপায় কী? হাসিনার পুলিশের সামনে বুক পেতে দিয়েছে যে তরুণ তারও যেমন এক ভোট, আর হাসিনার সুবিধা নিয়েছে যে তারও এক ভোট।
পঁচাত্তরের পর জিয়াউর রহমান গোপন ও প্রকাশ্য সব দলের জন্য রাজনীতি ওপেন করে দেন। ফলে দেখা গেল, আজীবন গোপন রাজনীতি করা নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসেন এবং সংসদ সদস্য হন। সামরিক নেতা জিয়াউর রহমানের সংসদ যে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল, এটা তার বড় কারণ। এটাই ছিল বাস্তবতা। গণতন্ত্রী শেখ সাহেবের সংসদ আর সামরিক জিয়া সরকারের সংসদের মধ্যে তুলনা করলে বৈচিত্র্য কোনটায় বেশি ছিল, টের পাবেন।
এই মুহূর্তে ভাবসাবে জামায়াত দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। তারা বলেছে, ক্ষমতায় গেলে শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র বানাবে। মানে যে গণতন্ত্রের ওপর ভর করে ক্ষমতায় যাবে, ক্ষমতায় গিয়ে সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ছুড়ে ফেলবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্ন তো আছেই। নাগরিক সমাজ আশঙ্কা করছে, এবার প্রধান বিরোধী দল হলে পরের নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় যেতে পারে। তারা সেই চেষ্টায় নেমে পড়েছে। এমনকি দলীয় লোগো থেকে আল্লাহর কালামও বাদ দিয়েছে। তাদের ছাত্রসংগঠন বিশ্বব্যাংকের পথ্য শিক্ষার বেসরকারিকরণের অংশ হিসেবে হলে হলে পানির ফিল্টারও দিয়েছে।
শোনা যাচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে জাপার জোট হতে পারে। আর জাপার সঙ্গে যদি লীগের ভোট যুক্ত হয়, তাহলে হিসাব উল্টে যেতে পারে। বিএনপি এখন জামায়াতকে আসন ছাড়তে চাচ্ছে না, জামায়াতের সঙ্গে জাপার জোট হলে এই জোট ক্ষমতায় ফিরলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। জামায়াত একটি ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন হওয়ায়, জাপার সঙ্গে ঐক্য বিষয়ে নেতারা যে বুঝ কর্মী-সমর্থকদের সামনে হাজির করবেন, তারা তা মেনে নেবে।
গণতন্ত্র মঞ্চ ও এনসিপি নেতারা জামায়াতের প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠা ঠেকাতে মরিয়াই হবেন সম্ভবত। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে মন্ত্রী হওয়ার চেয়ে জামায়াতকে প্রধান বিরোধী দলের জায়গা থেকে সরিয়ে আরও পেছনের বিরোধী দলে ঠেলে দিতে পারলে জাতির উপকার হবে। এবং তা সম্ভব করতে পারে গণতন্ত্র মঞ্চ ও এনসিপি নেতৃত্বাধীন জোটই। ইনু-মেনন-দীলিপ বড়ুয়া হওয়ার সুযোগ পায়ে ঠেলেই তা করতে হবে। জাতির স্বার্থে এই আত্মত্যাগ জনগণের সামনে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে ভূমিকা রাখবে।
খুবই সঠিক কথা, বিএনপির পাশাপাশি একটি বাংলাদেশপন্থি ও মধ্যপন্থিদের জোট জরুরি। এই জোটটি যদি দাঁড়ায়, তাহলে বিএনপি ও জামায়াতকে ভোট দেবে না যে বিপুল জনগোষ্ঠী, তারা একটা জায়গা পাবে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে আছে অভ্যুত্থানপন্থি ও সংস্কারপন্থি তরুণরা, তেমনি আছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা বয়স্ক প্রবীণরা।
এ ছাড়াও গণতন্ত্র মঞ্চ ও এনসিপি জোটের গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ্য বিএনপি ও জামায়াত থেকে তাদের আলাদাভাবে চেনাবে। অতীতে বহুবার দেখা গেছে, জামায়াতের চেয়ে অনেক কম শক্তি নিয়েও ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছে তারা। এই জোটের আলাদা কল্যাণমুখী অর্থনৈতিক কর্মসূচি, রাষ্ট্র প্রকল্প যদি জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে, ষাটের দশকের গণমুখী রাজনীতি আবার ফিরবে। প্রধান বিরোধী দল হতে পারলে ক্যারিসম্যাটিক চেহারায় ফিরতে পারবে। সঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কারের অসম্পূর্ণ কাজগুলো পূরণের দায় তো আছেই।
আর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কারণে রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন ঘটবে, তারও প্রভাব মাঠে পড়বে। দেখা যাবে পরিবারতন্ত্র ও সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে যে মেধাবী ও আত্মমর্যাদাশীল তরুণরা বিএনপি ও জামায়াতের মতো সংগঠনে যোগ দেয়নি, তারা এবার যোগ দেবে। পরিবেশ, নারী ও সংখ্যালঘু প্রশ্ন সামনের রাজনীতিতে প্রধান হয়ে উঠবে। এই ধারাটি যত বেশি শক্তিশালী হবে, ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ফের তত দুর্বল হতে থাকবে।
“নাহিদ হাসান : কবি, লেখক ও সংগঠক”
মতামত লেখকের নিজস্ব
(তথ্যসূত্র:দৈনিক আমাদের সময়)