
বিশেষ প্রতিবেদক: স্তনবৃদ্ধি এবং চোখের পাতার অস্ত্রোপচারকে উত্তর কোরিয়ায় সমাজতন্ত্রের পরিপন্থী আচরণ বলে মনে করা হয়। এই ধরনের কাজকর্ম সরকারি খাতায় অবৈধ। দোষী সাব্যস্ত হলে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে আমজনতাকে। শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন সব্বোনেশে। এই দেশটি অবশ্য শিবের নয়, কিম জং-উনের। উত্তর কোরিয়ার (ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া) দণ্ডমুণ্ডের কর্তা কিম। প্রায়শই তিনি নানা কঠিন শাসননীতি (পড়ুন ফতোয়া) জারি করে থাকেন দেশের জনগণের উপর। উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম এ বার কঠোর হয়েছেন মহিলাদের স্তনের আকার বৃদ্ধি নিয়ে।
মহিলাদের স্তন প্রতিস্থাপন নিয়ে আরও কঠোর নীতি প্রয়োগ করতে চলেছেন কিম। স্তন প্রতিস্থাপনের মতো কসমেটিক সার্জারিকে ‘বুর্জোয়া’ বলে উল্লেখ করে তা দমন করার পদক্ষেপ করেছেন তিনি। উত্তর কোরিয়ায় মহিলাদের মধ্যে স্তনের আকার বৃদ্ধি করার অস্ত্রোপচার অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেই অস্ত্রোপচার বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন কিম। ইতিমধ্যেই জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলিকে নির্বিচারে তল্লাশির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনকি স্তন প্রতিস্থাপন আটকাতে এলাকায় এলাকায় নজরদারি চালানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কোনও মহিলার শরীরে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা গেলেই তাঁদের শনাক্ত করার এবং পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্থানীয় নেতা বা পাহারাদার গোষ্ঠীকে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, কিমের দেশে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় বলে কিছু নেই। প্রশাসন মনে করলে বা চাইলে যখন-তখন যে কারও বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি চালাতে পারে। কোন পরিবারের মহিলা স্তন প্রতিস্থাপন করেছেন বা করাতে চাইছেন তা জানার জন্য কার্যত চিরুনিতল্লাশি চালাতে শুরু করেছেন কিমের আধিকারিকেরা।
স্তনবৃদ্ধি এবং চোখের পাতার অস্ত্রোপচারকে উত্তর কোরিয়ায় সমাজতন্ত্রের পরিপন্থী আচরণ বলে মনে করা হয়। এই ধরনের কাজকর্ম সরকারি খাতায় অবৈধ। দোষী সাব্যস্ত হলে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। সর্বাধিনায়ক কিম মনে করেন, এই ধরনের অস্ত্রোপচার করার প্রবণতা সমাজতন্ত্রের বিরোধী এবং এতে নাগরিকদের মধ্যে ‘বুর্জোয়া’ মানসিকতার প্রতিফলন ফুটে উঠছে।
গত সেপ্টেম্বরে একটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই স্তন প্রতিস্থাপন বন্ধ করার জন্য কার্যত খেপে ওঠেন কিম। সম্প্রতি উত্তর হোয়াংহো প্রদেশের একটি সূত্র মারফত সংবাদটি জানতে পারে দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম ‘ডেইলি এনকে’। সেই প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি উত্তর কোরিয়ার সারিওনের এক চিকিৎসক অবৈধ ভাবে দুই তরুণীর স্তন প্রতিস্থাপন করেছেন। সেই চিকিৎসক ও দুই তরুণীকে স্থানীয় একটি সংস্কৃতিকেন্দ্রে গণশুনানিতে ডাকা হয়। জনসমক্ষে তাঁদের বিচার চলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলা সেই শুনানিতে কার্যত মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অভিযুক্ত চিকিৎসক ও ২০ বছরের দুই তরুণীকে। হাজার হাজার কোরীয় নাগরিক হাজির হয়েছিলেন বিচারের নামে সেই প্রহসন দেখতে। লজ্জায় মাথা তুলতে পারেননি অভিযুক্তেরা।
সূত্রটি জানিয়েছে যে, ওই চিকিৎসক তাঁর বাড়িতে অবৈধ ভাবে স্তন প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করার জন্য চিন থেকে চোরাচালান করা ‘সিলিকন ইমপ্ল্যান্ট’ ব্যবহার করেছিলেন। আমদানি করা সেই অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম, চিকিৎসককে দেওয়া অর্থ প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল শুনানিতে।
সূত্রের খবর অনুসারে, এক জন প্রাক্তন মেডিক্যাল ছাত্র মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে অবৈধ ক্লিনিকে স্তন প্রতিস্থাপনের ব্যবসা খুলে বসেছিলেন। চোরাপথে চিন থেকে সরঞ্জাম আমদানি করতেন। কিম সরকারের আধিকারিকেরা রোগীর ছদ্মবেশে হানা দেন ওই আধা-চিকিৎসকের ক্লিনিকে। হাতেনাতে ধরা পড়েন প্রাক্তন মেডিক্যাল পড়ুয়া।
রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ের দক্ষিণে অবস্থিত শহর সারিওনের বাসিন্দাদের বলা হয়েছে যে, নজরদারির দায়িত্বে থাকা কিমের বশংবদ, পারিষদ ও নেতারা এখন থেকে অস্ত্রোপচার করা মহিলাদের চিহ্নিত করবেন। সন্দেহ হলে তাঁদের মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। বিচার চলাকালীন সরকারি আইনজীবী জানান, যাঁরা স্তনের আকৃতির বদল ঘটানোর জন্য কৃত্রিম উপায়ে অস্ত্রোপচারের সাহায্য নিচ্ছেন তাঁদের মধ্যে ‘বুর্জোয়া’ রীতিনীতির প্রভাব পড়েছে। এই মনোভাব সমাজতন্ত্রের ভাবনা ও আদর্শকে কলুষিত করছে। পচাগলা পুঁজিবাদী আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন কোরীয় মহিলারা।
যাঁরা শারীরিক গঠন উন্নত করার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন বা ইতিমধ্যেই সেই কাজ করে ফেলেছেন, তাঁদের ‘সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি’ বলে মনে করছে কিম জংয়ের সরকার। তবে এরই মধ্যে উত্তর কোরিয়ার তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের মধ্যে স্তনের আকার নিখুঁত করে তোলার ঝোঁক প্রচণ্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই প্রবণতা আটকাতে মরিয়া কিমের সরকার। পিয়ংইয়ংয়ের জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয় নির্দেশ জারি করেছে, ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে মহিলাদের। অপরাধী সাব্যস্ত হলে একনায়কতন্ত্রের শ্রমশিবিরে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে পারেন তাঁরা। এ ছাড়াও অবৈধ কাজে যুক্ত থাকা চিকিৎসককেও ফৌজদারি শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে। বিদেশি প্রভাব, মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন উত্তর কোরিয়ার সর্বাধিনায়ক কিম। বিভিন্ন নিয়মের নাগপাশে জনতাকে বাঁধার জন্য আরও কঠোর হচ্ছেন তিনি। দেশের নাগরিকদের জন্য বাইরের জগতের দরজা একেবারেই বন্ধ করে দিতে চাইছেন একনায়ক।
ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ, ইউটিউবের মতো কোনও সমাজমাধ্যমই উত্তর কোরিয়ায় ব্যবহৃত হয় না। সেখানকার প্রশাসক কিম শাসক হিসাবে ক্ষমতা দখল করে প্রথম থেকেই সে সব নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। বিদেশি কোনও জিনিসই সেখানকার মানুষ ব্যবহার করতে পারেন না।
২০২০ সালে কিমের দেশে নতুন একটি আইন আনা হয়। সেখানে বলা হয়, দক্ষিণ কোরিয়ার ফিল্ম, সিরিজ় বা নাটকের মতো কোনও বিনোদনমূলক বিষয়বস্তু দেখা অথবা প্রচার করা উত্তর কোরিয়ায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। তার শাস্তিও চরম, হতে পারে মৃত্যুদণ্ড। বাড়ি বাড়ি তল্লাশির প্রবণতা ২০২১ সাল থেকে আরও বেড়ে গিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে। বিদেশি সংস্কৃতির কোনও ছোঁয়া কোনও বাড়িতে রয়েছে কি না, তার খোঁজে দিনের পর দিন অক্লান্ত ভাবে তল্লাশি চালিয়ে যান কিমের আধিকারিকেরা। কিমের এই ধরনের বিদেশি সংস্কৃতিবিরোধী কার্যকলাপে তটস্থ সে দেশের মানুষ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংবাদমাধ্যমের অভিযোগ, বিদেশি সংস্কৃতির বিরোধিতা করার নামে কিম আসলে নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় আরও হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন।