
-
“অধিবেশনের ফাঁকে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিও’র মেহেদি হাসানকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই সাক্ষাৎকারে *জুলাই গণ অভ্যুত্থান, *আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, *অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়া, *শেখ হাসিনাকে ভারতের আশ্রয়, *আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, *নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে যা কথা বলেছেন তিনি”
বি এম শফিকুল ইসলাম টিটু, সিনিয়র চীফ রিপোর্টার (বাংলাদেশ): জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফর করছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার এই সাক্ষাৎকারের একটি বড় অংশজুড়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে তাঁর ভাবনা উঠে এসেছে অনেকাংশে। আমাদের সকল পাঠক কে জানানোর জন্য প্রশ্নোত্তর হিসেবে হুবহু ওই সাক্ষাৎকারের প্রাপ্ত মূল তথ্য এই অংশ তুলে ধরা হলো-
*ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিও’র মেহেদি হাসান এর জিজ্ঞাসা ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উত্তর দেখুন*
মেহদি হাসান: বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জিটিওতে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ইউনূস: আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহদি হাসান: আমরা শেষবার যখন কথা বলেছিলাম, তার পর থেকে অনেক কিছু ঘটেছে। আমার মনে হয়, আমাদের শেষ কথা হয়েছিল ২০১৭ সালে। তখন আপনি একজন সাধারণ নাগরিক ছিলেন। আপনার পরিচয় ছিল শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একজন অর্থনীতিবিদ। কিন্তু আপনি তখন একটি দেশ পরিচালনা করছিলেন না। এক বছরের কিছুটা বেশি সময় আগে, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। প্রায় দুই দশক ধরে তিনি আপনার দেশে কার্যত একজন একনায়ক ছিলেন এবং একাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। তাঁর বিদায়ে অনেকেই খুশি হয়েছিলেন। তাঁর সরকারের পতনে আপনার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল? সেই দিন বা রাত সম্পর্কে আপনার কী মনে পড়ে। সেই রাতে আপনার কেমন অনুভব হচ্ছিল—ভয়, আশা, নাকি বিস্ময়?
অধ্যাপক ইউনূস: রোমাঞ্চকর, রোমাঞ্চকর। হ্যাঁ, সত্যিই। অবশেষে এটা ঘটল। এটা ছিল অসাধারণ এক খবর।
মেহদি হাসান: আপনি কি ভেবেছিলেন এমনটা ঘটবে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না, এটা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। বিক্ষোভ চলছিল, যেমনটা আপনি বাংলাদেশে দেখতে পাবেন। কিন্তু এমন কিছু ঘটবে, তা ভাবিনি। পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। তিনি দেশ ছাড়ার আগে কী ঘটেছিল, তার বিস্তারিত আমি তখন জানতাম না। তবে শেষ খবরটা ছিল, তিনি চলে গেছেন। সেটি ছিল রোমাঞ্চকর।
মেহদি হাসান: গত এক বছরে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? আপনারা বিপ্লবের এক বছর পূর্তি উদযাপন করলেন। মাত্রই প্রথম বার্ষিকী পালন করেছেন। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতিটা কেমন? এখনো কি আশাবাদ, রোমাঞ্চ ও আশা রয়েছে, নাকি পরিবর্তনের ধীরগতির জন্য হতাশা তৈরি হয়েছে?
অধ্যাপক ইউনূস: সবকিছুই আছে। কিছু ঘটছে এই উত্তেজনার পাশাপাশি সব মিলিয়ে হতাশাও আছে। হতাশা-কারণ, মানুষ অভিযোগ করতে ভালোবাসেন। এটা একটি সাধারণ বিষয়। তাঁরা আরও চান। প্রত্যাশার মাত্রা অনেক বেশি। তাঁরা চান সব কিছু এখনই হোক, আগামীকাল নয়। তাই যদি আজ কিছু না হয়, তাহলে আপনি ভালো নন। বিষয়গুলো এ ধরনের, তবে এটি একটি ভালো দিক। নেতিবাচক নয়। এটি কেবল উচ্চ প্রত্যাশা।
মেহদি হাসান: হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ছাত্র আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা আপনাকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। ওই সিদ্ধান্তে কি আপনি অবাক হয়েছিলেন? আর আপনি কেন মনে করেন, তাঁরা আপনাকে চেয়েছিলেন, একজন অরাজনীতিক, একজন অর্থনীতিবিদ এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে বলছি আশির কোঠায় থাকা একজন ব্যক্তিকে? তাঁরা কেন আপনাকে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নিলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি অবাক হয়েছিলাম, কারণ, আমি তাদের চিনি না। কখনো তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কখনো তাদের সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। প্রথমে আমার প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের কাছে একটি বার্তা আসে যে ছাত্ররা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। তারা চায়, আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করুন। আমি বললাম, তাদের উপেক্ষা করুন। এই আলোচনায় যুক্ত হয়েন না। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল যে এমনটা হচ্ছে না। পরদিন তারা সরাসরি আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কারণ, আমার সহকর্মীদের মাধ্যমে তাদের কাজটা হচ্ছিল না। তারা আমাকে কল দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করেছিল। আমি বলেছিলাম, না, অন্য কাউকে খোঁজো। আমি এর সঙ্গে জড়াতে চাই না। তিন দিন ধরে এই আলোচনা চলল। আমি এটা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছিলাম। আর তারা বারবার অনুরোধ করছিল।
মেহদি হাসান: তখন কিসের জন্য আপনি এটা করলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: অবশেষে তারা পরিস্থিতিটা তুলে ধরল। দেখুন, ছাত্ররা রক্ত দিয়েছে, আত্মত্যাগ করেছে, শিশুদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আরও অনেক কিছু ঘটেছে। তারা চায়, আপনি আসুন। এ সবকিছু বাদ দিন। দেশের কী হবে? তারা খুব করে এটি চেয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে তারা যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছিল। অবশেষে আমি বললাম, ঠিক আছে, তোমরা যখন এত আত্মত্যাগ করেছ, তাহলে আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করব। আমি দেখব তোমাদের জন্য কী করতে পারি।
মেহদি হাসান: আপনি আত্মত্যাগ ও রক্তপাতের কথা উল্লেখ করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল যে গত গ্রীষ্মে ছাত্র আন্দোলনে হাসিনার দমনমূলক পদক্ষেপে আনুমানিক ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ এখন আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে। অবশ্যই আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন যে তিনি ভারতে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। সেখানে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুরক্ষায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে বাংলাদেশে ফেরানোর জন্য আপনি বারবার অনুরোধ করেছেন। জবাবদিহির জন্য তাঁকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিতে আপনার আহ্বান মোদি উপেক্ষা করায় আপনি কী করেছেন? আপনি কি বিশ্বাস করেন, ভারত কখনো হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে?
অধ্যাপক ইউনূস: তারা যদি নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সম্ভবত তারা তাঁকে রেখে দেবে। যদি আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে থাকে, যা তারা এড়াতে পারবে না, তখন পরিস্থিতিটা ভিন্ন হবে।
মেহদি হাসান: তাঁকে রাখার পেছনে ভারতের স্বার্থ কী?
অধ্যাপক ইউনূস: তারা বরাবরই তাঁকে সমর্থন করে আসছে। যাঁরা তাঁর পেছনে আছেন, তাঁরা সম্ভবত এখনো আশা করছেন যে তিনি পূর্ণ গৌরবের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন, একজন বিজয়ী নেতা হিসেবে ফিরছেন।
মেহদি হাসান: নিউইয়র্ক টাইমস খবর প্রকাশ করেছে যে তিনি (শেখ হাসিনা) আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভার্চুয়্যালি বৈঠক করছেন। এটা কি আপনাকে উদ্বিগ্ন করে যে ভারত তাঁকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে এবং আবার ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টার করছে?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি ঠিক এভাবে কথাগুলো বলব না। তবে এ সম্ভাবনা রয়েছে যে বাইরের কিছু শক্তি তাঁকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে সহায়তা করবে। আমরা সব সময় এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
মেহদি হাসান: আপনি কি মোদির সঙ্গে কথা বলেছেন?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি মোদির সঙ্গে কথা বলেছি।
মেহদি হাসান: আপনি যখন শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ফিরিয়ে দিতে বললেন, তখন মোদি কী বলেছিলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: দুটি বিষয়। প্রথমত, আমি বলেছিলাম, আপনারা যদি তাঁকে রাখতে চান, তাঁর সঙ্গে কী করবেন, তা আমি আপনাকে বলতে পারি না। তবে এটা নিশ্চিত করেন যে তিনি আমাদের সম্পর্কে কথা বলবেন না। তিনি যেন বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে কথা না বলেন।
মেহদি হাসান: দুঃখিত, মোদি আপনাকে এ কথা বলেছিলেন, নাকি আপনি তাঁকে বলেছিলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি মোদিকে বলেছিলাম। বলেছিলাম যে অনুগ্রহ করে নিশ্চিত করেন।
মেহদি হাসান: তিনি কী বলেছিলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: তিনি বলছিলেন, আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।
মেহদি হাসান: হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপনার সরকার তাঁর সাবেক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে, তাদের নিবন্ধন স্থগিত করেছে, কার্যত পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে তাদের নিষিদ্ধ করেছে। আপনার মতোই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন—যিনি আপনাকে খুব ভালো করেই চেনেন, তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, এটা পূর্ববর্তী সরকারের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে, যারা ক্ষমতায় এসে তাদের বিরোধীদের নিষিদ্ধ করেছিল। আপনি কেবল সেই চক্রের পুনরাবৃত্তি করছেন। অমর্ত্য সেন ও অন্যদের এ ধরনের সমালোচনার কী জবাব দেবেন আপনি?
অধ্যাপক ইউনূস: এটা ভুল সমালোচনা। কারণ, আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি।
মেহদি হাসান: আমি বলছি, আপনি তো নিবন্ধন স্থগিত করেছেন?
অধ্যাপক ইউনূস: না, তাদের নিবন্ধনও নয়। নিবন্ধন বন্ধ করতে আদালতের রায় ও মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশের প্রয়োজন রয়েছে। নিবন্ধন বন্ধ করা সময় সাপেক্ষ ব্যপার। শুধু তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
মেহদি হাসান: এর অর্থ কী?
অধ্যাপক ইউনূস: এর অর্থ হলো, তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারবে না।
মেহদি হাসান: তাহলে আপনি মূলত, আমি বলছি, তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না।
অধ্যাপক ইউনূস: না, না। দলটি এখনো আছে। তাছাড়া একটি রাষ্ট্রের বৃহৎ কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে বিভিন্ন ধরনের আইনী পদক্ষেপ নিতে হয়। আমরা এখনো পর্যন্ত কোনও আইনী পদক্ষেপ গ্রহন করিনি।
মেহদি হাসান: তারা কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে?
অধ্যাপক ইউনূস: না, এখন পারবে না। নির্বাহী আদেশে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে নির্বাচনটাও এর অংশের মধ্যেই পড়ে।
মেহদি হাসান: ঠিক আছে, তাহলে এটা কীভাবে…? পেছনে ভারতের স্বার্থ কী?
অধ্যাপক ইউনূস: তারা বরাবরই তাঁকে সমর্থন করে আসছে। যাঁরা তাঁর পেছনে আছেন, তাঁরা সম্ভবত এখনো আশা করছেন যে তিনি পূর্ণ গৌরবের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন, একজন বিজয়ী নেতা হিসেবে ফিরছেন।
মেহদি হাসান: নিউইয়র্ক টাইমস খবর প্রকাশ করেছে যে তিনি (শেখ হাসিনা) আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভার্চুয়্যালি বৈঠক করছেন। এটা কি আপনাকে উদ্বিগ্ন করে যে ভারত তাঁকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে এবং আবার ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টার করছে?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি ঠিক এভাবে কথাগুলো বলব না। তবে এ সম্ভাবনা রয়েছে যে বাইরের কিছু শক্তি তাঁকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে সহায়তা করবে। আমরা সব সময় এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
মেহদি হাসান: আপনি কি মোদির সঙ্গে কথা বলেছেন?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি মোদির সঙ্গে কথা বলেছি।
মেহদি হাসান: আপনি যখন তাঁকে (শেখ হাসিনা) বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ফিরিয়ে দিতে বললেন, তখন তিনি (মোদি) কী বলেছিলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: দুটি বিষয়। প্রথমত, আমি বলেছিলাম, আপনারা যদি তাঁকে রাখতে চান, তাঁর সঙ্গে কী করবেন, তা আমি আপনাকে বলতে পারি না। তবে এটা নিশ্চিত করেন যে তিনি আমাদের সম্পর্কে কথা বলবেন না। তিনি যেন বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে কথা না বলেন।
মেহদি হাসান: দুঃখিত, মোদি আপনাকে এ কথা বলেছিলেন, নাকি আপনি তাঁকে বলেছিলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি মোদিকে বলেছিলাম। বলেছিলাম যে অনুগ্রহ করে নিশ্চিত করেন।
মেহদি হাসান: তিনি কী বলেছিলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: তিনি বলছিলেন, আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।
মেহদি হাসান: হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপনার সরকার তাঁর সাবেক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে, তাদের নিবন্ধন স্থগিত করেছে, কার্যত পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে তাদের নিষিদ্ধ করেছে। আপনার মতোই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন—যিনি আপনাকে খুব ভালো করেই চেনেন, তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, এটা পূর্ববর্তী সরকারের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে, যারা ক্ষমতায় এসে তাদের বিরোধীদের নিষিদ্ধ করেছিল। আপনি কেবল সেই চক্রের পুনরাবৃত্তি করছেন। অমর্ত্য সেন ও অন্যদের এ ধরনের সমালোচনার কী জবাব দেবেন আপনি?
অধ্যাপক ইউনূস: এটা ভুল সমালোচনা। কারণ, আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি।
মেহদি হাসান: আমি বলছি, আপনি তো নিবন্ধন স্থগিত করেছেন?
অধ্যাপক ইউনূস: না, নিবন্ধন নয়। শুধু তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
মেহদি হাসান: এর অর্থ কী?
অধ্যাপক ইউনূস: এর অর্থ হলো, তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারবে না।
মেহদি হাসান: তাহলে আপনি মূলত, আমি বলছি, তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না।
অধ্যাপক ইউনূস: না, না। দলটি এখনো আছে। তাছাড়া একটি রাষ্ট্রের বৃহৎ কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে বিভিন্ন ধরনের আইনী পদক্ষেপ নিতে হয়। আমরা এখনো পর্যন্ত কোনও আইনী পদক্ষেপ গ্রহন করিনি।
মেহদি হাসান: তারা কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে?
অধ্যাপক ইউনূস: না, এখন পারবে না। নির্বাহী আদেশে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে নির্বাচনটাও এর অংশের মধ্যেই পড়ে।
মেহদি হাসান: ঠিক আছে, তাহলে এটা কীভাবে… তারা কি দল হিসেবে বৈধ?
অধ্যাপক ইউনূস: আচ্ছা, তারা দল হিসেবে অবশ্যই বৈধ, তবে এখন শুধু মাত্র তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত। যেকোনো সময় তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু করা হতে পারে।
মেহদি হাসান: আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি স্থগিতাদেশ তুলে নিতে পারেন?
অধ্যাপক ইউনূস: স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া মানে, তবে হ্যাঁ- তুলে নেওয়ার বিষয়ে আমাদের একটা সম্ভাবনা রয়েছে।
মেহদি হাসান: তাহলে আপনি দলটিকে নিষিদ্ধ করতে পারেন নি। আপনি শুধু বলেছেন, এখনকার জন্য তোমরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছ না।
অধ্যাপক ইউনূস: হ্যাঁ, এটাই ঠিক।
মেহদি হাসান: কিন্তু একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মানুষকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে নিষিদ্ধ করাটা কতটা গণতান্ত্রিক বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক ইউনূস: দেখুন, নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এটা করেছে দলটির চরিত্র ও সম্ভাবনা দেখে যে তারা পুরো নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই তারা ভেবেছে, এটা না করাই ভালো…
মেহদি হাসান: কিন্তু আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে বাংলাদেশে তাদের এখনও লাখ লাখ সমর্থক রয়েছে? তারা কি রাজনৈতিক দল হিসেবে বৈধ?
অধ্যাপক ইউনূস: আচ্ছা, তারা দল হিসেবে অবশ্যই বৈধ, তবে এখন শুধু মাত্র মাঠ পর্যায়ে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করেছি। তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করা হবে। নিবিড়ভাবে তদন্ত করে যেকোনো সময় তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম আবার চালু করে দিতে পারি।
মেহদি হাসান: আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ তুলে নিতে পারেন?
অধ্যাপক ইউনূস: স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া মানে, তবে হ্যাঁ- এটার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নির্বাচনের পূর্বে তার সম্ভাবনা নেই।
মেহদি হাসান: তাহলে আপনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারেন নি। আপনি শুধু বলেছেন, এখনকার জন্য তোমরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছো না।
মেহদি হাসান: কিন্তু একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মানুষকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে নিষিদ্ধ করাটা কতটা গণতান্ত্রিক বলে আপনি মনে করেন? মহামান্য আদালতের কোন প্রকার রায় বা আদেশ ব্যতিত তাদের প্রতিক নৌকা তো ব্যালটে থাকবে, না কি?
অধ্যাপক ইউনূস: দেখুন, রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশ বা আদালতের রায় ছাড়াতো আর প্রতিক বাতিল করা যায় না, তাই নির্বাচন কমিশন এটাকে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথবা নির্বাচন কমিশন তাদের কোন বিধানে যদি বাতিল করবার প্রক্রীয়া থাকে, তাহলে বাতিলও করে দিতে পারে। এই বিষয়টা সম্পূর্নরূপে নির্বাচন কমিশনের অগ্রাধিকার। তবে, নির্বাচন কমিশন এমনটা মনে করেছে, দলটির চরিত্র ও সম্ভাবনা দেখে আমাদের মনে হয়েছে যে, তারা পুরো নির্বাচন প্রক্রীয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই তারা ভেবেছে, এটা না করাই ভালো…
মেহদি হাসান: কিন্তু আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে বাংলাদেশে তাদের লাখ লাখ সমর্থক আছেন?
অধ্যাপক ইউনূস: এখনও লাখ লাখ কর্মী আছে কি না তা আমি বলতে পারবো না। তবে প্রবীন সংগঠন হিসেবে তাদের অনেক সমর্থক আছে। কিন্তু কতজন অবশিষ্ট আছে, তা আমি জানি না। কারণ, সমর্থক এমন একটি বিষয় যে আপনি খুব ক্ষমতাধর, আমি সব সময় আপনার সামনে মাথা নত করি, কারণ, আপনি ক্ষমতাধর। আমি একজন সমর্থক হয়ে তা করছি না।
মেহদি হাসান: কিন্তু আপনি এটা অস্বীকার করতে পারেন না যে বাংলাদেশে তাদের ভোটার আছে।
অধ্যাপক ইউনূস: অবশ্যই, এটা বাংলাদেশের পুরাতন ও বৃহৎ রাজনৈতিক একটি দল।
মেহদি হাসান: কিন্তু এখন সেই ব্যক্তিদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই। আপনি তাঁদের দলকে নিষিদ্ধ করেছেন। আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি তাঁদের দলকে সাময়িকভাবে রাজনীতিতে অংশ নিতে বাধা দিয়েছেন।
অধ্যাপক ইউনূস: এখন, প্রতিক যদি নির্বাচন কমিশন বহাল রাখে, তবে তাঁরা ভোটার হিসেবে ওই প্রতিকে ভোট দিতে পারেন। তাঁরা বৈধ ভোটার। আবার তাদের অনেক প্রতিদ্ধন্ধিওতো আছেন। তাঁরা নিজেদেরটা বেছে নেবেন। আওয়ামী লীগের মার্কাটা সেখানে থাকবে কি না।
মেহদি হাসান: কিন্তু এটা কি ভালো হবে? পরিস্থিতিটা থাকা কি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে, যেখানে মানুষ বলছে, নতুন সরকার পুরোনো সরকারের ওপর দমনপীড়ন চালাচ্ছে, চক্রটা চলতেই থাকল?
অধ্যাপক ইউনূস: অন্যথায় আমরা নির্বাচন করতে পারব না। এটা যদি মোটের ওপর একটা দল হয়, একটি রাজনৈতিক দল, তারা একটি রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করছে না। তারা যে মানুষ হত্যা করেছে, সে জন্য অনুশোচনাও প্রকাশ করেনি। এই সময়ে তারা যা যা করেছে, তার কোনো কিছুরই দায় নেয়নি-একটি বিষয়েরও না। সব সময় অভিযোগ করছে যে এর জন্য অন্য কেউ দায়ী। যদি তারা তাদের দোষ মেনে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিত, আর বাংলাদেশের সাধারন নাগরিক যদি তাদেরকে নিষিদ্ধ করার জন্য মাঠে নেমে আন্দোলন না করে, ক্ষমা করে দিত, তবেই তো আর কোনও কার্যক্রম নিষিদ্ধ বা স্থগিতাদেশ দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। এখনও অনেক সময় এবং সুযোগ রয়েছে। তারা বিগত জুলাইয়ের ছাত্র জনতার আন্দোলনের সকল হত্যার দ্বায় মেনে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমাও করতে জানে। যদি রাষ্ট্রের মানুষ ক্ষমা করে দেয়। তাহলে, আমার তো আর এখানে কোন স্বার্থ নাই- আমি ইচ্ছা করলেই কি একটি পুরাতন ও বৃহৎ রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে পারি?