Home অর্থনীতি ও বানিজ্য বাংলাদেশে তীব্র গ্যাস সংকটে থমকে যাচ্ছে তৈরী পোশাক শিল্পখাত

বাংলাদেশে তীব্র গ্যাস সংকটে থমকে যাচ্ছে তৈরী পোশাক শিল্পখাত

0
11

বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদক: দেশের বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকের প্রতিদিনের গ্যাসের চাহিদার চার ভাগের এক ভাগও মেলে না নিজস্ব উৎস থেকে। বাকি চাহিদা পূরণে বিদেশ থেকে আনা হয় এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস)। গড়ে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হয়। এর ফলে মোট জোগান দাঁড়ায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। অথচ পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন অন্তত ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। অর্থাৎ, দেশের মোট চাহিদার অর্ধেকই পূরণ হচ্ছে না।
এক নিবিড় অনুসন্ধানে যা জানাগেল, নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রত্যাশিত ফল আসছে না। বরং দিন দিন এলএনজি আমদানি নির্ভরতা বেড়েই চলেছে। এর ফলে বাংলাদেশের শিল্পায়ন ভবিষ্যতে আরও ব্যয়বহুল জ্বালানি নির্ভর হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ, সস্তায় গ্যাস পাওয়ার যুগ শেষ হতে চলেছে। শিল্প মালিকদের এখন থেকে উচ্চমূল্যে জ্বালানি কিনতে হবে, যা শিল্পোৎপাদন ও বিনিয়োগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
দেশে ২০১০ সালে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শিল্পে গ্যাসের দাম ছিল ৬ থেকে ১২ টাকার মধ্যে। শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ ছিল এই টাকায়। আবাসিক গ্রাহকদের তখন ডাবল বার্নার গ্যাসের দাম ছিল ৪০০ টাকা। পর্যায়ক্রমে গত এক যুগে বর্তমানে শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪০ টাকা, ক্যাপটিভে ৪২ টাকা। আবাসিকে ডাবল বার্নার চুলায় গ্যাসের দাম ১ হাজার ৮০ টাকা। গ্যাসের এই দাম আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ওপর সোমবার গণশুনানির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। প্রায় সবক্ষেত্রেই গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর একই যুক্তি থাকছে। সেটা হলো গ্যাসের সংকটের কারণে বিদেশ থেকে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে ভর্তুকি কমাতে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। অবশ্য পেট্রোবাংলার গ্যাস আমদানি হিসাব দেখলেও বোঝা যায় এলএনজি আমদানি প্রতি ঘনমিটার ৬৮ টাকা পর্যন্ত পড়েছে। সেখানে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ করছে প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা। তবে দেশীয় উৎস থেকে উৎপাদিত গ্যাসের দাম কম থাকায় বিদেশ থেকে আমদানি করা ব্যয়বহুল এলএনজির সঙ্গে দেশীয় গ্যাসের মিশ্রণের ফলে এলএনজি আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে সরবরাহে করতে পারছে পেট্রোবাংলা। তবে সেখানে সরকারের হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি লাগছে। দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও ভর্তুতি থেকে বের হতে পারছে না সরকার।
পেট্রোবাংলার এক বার্ষিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশি উৎস থেকে পাওয়া গ্যাসের গড় দাম পড়েছে ৩ দশমিক ৩৯ টাকা। একই পরিমাণ গ্যাস এলএনজি আকারে বিদেশ থেকে আমদানিতে খরচ পড়েছে ৬৮ দশমিক ৭১ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া ৭২ দশমিক ২১ শতাংশ গ্যাসের দাম পড়েছে ৬ হাজার ৬২৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। একই সময়ে আমদানিকৃত মাত্র ২৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ গ্যাসের দাম পড়েছে ৪৩ হাজার ৫৯১ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশি উৎস থেকে পাওয়া ১৯ হাজার ৫৬৩ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ঘনমিটার, আর আমদানি করে জোগান দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ১৯৭ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। রাষ্ট্রীয় তিনটি কোম্পানির উৎপাদিত গ্যাস প্রতি ঘনমিটারের গড় মূল্য পড়েছে ১ দশমিক ৪৪ টাকা। বহুজাতিক কোম্পানির চার গ্যাস ক্ষেত্রের গ্যাসের দাম পড়েছে ৪ দশমিক ৬৮ টাকা দরে। রাষ্ট্রীয় একমাত্র অনুসন্ধান ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জোগান দিয়েছে ১ হাজার ১৪৮ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ঘনমিটার, কোম্পানিটিকে ৪ টাকা হারে দাম পরিশোধ করে পেট্রোবাংলা। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড জোগান দিয়েছে ৫ হাজার ৩২৬ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন ঘনমিটার, সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড জোগান দিয়েছে ১ হাজার ৩৪৯ দশমিক ১১ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস। কোম্পানি দুটিকে এক টাকা হারে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি) শেভরন, টাল্লোর অধীনে থাকা বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার, জালালাবাদ ও বাংগুরা থেকে জোগান এসেছে ১১ হাজার ৭৩৯ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ঘনমিটার। কোম্পানিগুলোকে চুক্তি অনুযায়ী পরিশোধিত গ্যাসের গড় মূল্য পড়েছে ৪ দশমিক ৬৮ টাকা। এদিকে একই সময়ে কাতার গ্যাস (রাশ গ্যাস) থেকে জি-টু-জি ভিত্তিতে আনা ৩ হাজার ৪০৩ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৩৮৮ দশমিক ৫০ মিলিয়ন টাকা। এতে প্রতি ঘনমিটারের দাম পড়েছে ৪৭ দশমিক ৪২ টাকা। ওমান থেকে জি-টু-জি ভিত্তিতে আনা ১ হাজার ১৯১ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস ৪৪ দশমিক ৫৬ টাকা হারে পড়েছে ৫৩ হাজার ৮০ দশমিক ১৪ মিলিয়ন টাকা। আর স্পর্ট মার্কেট থেকে দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজির দাম পড়েছে ৬৫ দশমিক ০৬ টাকা করে। স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা ৩ হাজার ৪০৩ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৪৪৩ মিলিয়ন টাকা। এলএনজি মূসক (৭.২০ টাকা) রি-গ্যাসিফিকেশন (২.৬৩ টাকা) উৎসে কর (২.৪৭ টাকা), এআইটি (১.০৭ টাকা) যুক্ত হওয়ার পর আমদানিকৃত গ্যাসের দাম পড়েছে ৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৪১ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশীয় উৎস থেকে মোট গ্যাসের গড় দাম পড়েছে ৩ দশমিক ৩৯ টাকা। আমদানিকৃত গ্যাসের গড় দাম পড়েছে ৬৮ দশমিক ৭১ টাকার মতো। দেশীয় ৭২ দশমিক ২১ শতাংশ গ্যাসের সঙ্গে আমদানি করা ২৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ গ্যাসের মিশ্রিত ক্রয়মূল্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, আজকে দেশের জ্বালানি খাত যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, সেটা বিগত সরকাগুলো ইচ্ছে করে এখানে নিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা বার বার বলেছি দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেশি করে গ্যাসের অনুসন্ধান করতে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি আমদানির দিকে নিয়ে গেছে। এখন আমদানি করা জ্বালানি নির্ভর হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, এ অবস্থায় অবশ্যই দেশের শিল্পায়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
বিকেএমইএর সভাপতি মো. হাতেম বলেন, বার বার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকার এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, দেশের শিল্পকারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা সত্যি চ্যালেঞ্জের। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরও শিল্প মালিকরা গ্যাস পান না ঠিকমতো। এ অবস্থায় আবার গ্যাসের দাম বাড়ানো এবং গ্যাসের জোগান যদি ঠিক রাখা না হয়, তবে অর্থনীতির জন্য খারাপ খবর হবে। বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে দেশের শিল্পখাত।
এদিকে সরকার বিভিন্ন সময় দেশে গ্যাসের অনুসন্ধানের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সেটা কার্যত কাক্সিক্ষত সুফল অর্জন করতে পারেনি। বিগত এক দশকে ভোলা, সিলেটে কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র এবং গ্যাসকূপ থেকে গ্যাস পেলেও দেশের চাহিদার তুলনায় সেটা খুবই কম। এখনও দেশের অভ্যন্তরে গ্যাসে অনুসন্ধান ও খনন কার্যক্রম চলছে। তবে সরকার এসবের চেয়ে এলএনজি আমদানির দিকে বেশি নজর দিয়েছে। গত মাসে এলএনজি আমদানিতে বাংলাদেশে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কোম্পানির সঙ্গে একটি বড় চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। মার্কিন কোম্পানি অ্যাকসিলারেট এনার্জির সঙ্গে এ চুক্তি করে সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের উডল্যান্ডে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এলএনজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাক্সিলারেট। বাংলাদেশের এ কোম্পানি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। এ ছাড়া এরই মধ্যে কাতার, ওমান, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব থেকে এলএনজি আমদানি করতেছে সরকার। এলএনজি আমদানির সক্ষমতা বাড়াতে নতুন করে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগও গ্রহণ করেছে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here